ছোটো গল্প
15% OFF * FREE SHIPPING
ছোটো গল্প
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য
“বুঝলেন মশাই, কিছু জায়গা আছে যেখানে গেলে গায়ে কাঁটা দেবেই দেবে। পরে লোকের মুখে শুনেও বোঝা যায় সে-সব জায়গায় অলৌকিক কিছু ব্যাপার আছে। ওসব শুনলে এমনিতেই গা ছমছম করবে লোকের, আমার করবে না! গায়ের লোম আপনা থেকেই দাঁড়িয়ে যায়। কী যে হয় শরীরে কে জানে মশাই।”
দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, “হয় মশাই, সকলেরই হয়। জায়গার একটা প্রভাব থাকে। কামাখ্যা মন্দিরের ওপরের সিঁড়ি বেয়ে ভুবনেশ্বরী মন্দিরে...” শেষ করতে পারলেন না কথাটা তিনি।
মুখের কথা কেড়ে নিলে রাগ হয় লোকের। গদির মালিক আবার বললেন, “আরে শুনুন না! বিখ্যাত তান্ত্রিক লেখক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী বলেছিলেন আমি নাকি ভালো মিডিয়াম। ভর হতে পারে আমার ওপর। অথচ আমি ভূত-ভগবান, তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করি এমন মোটেই নয়। ছোটবেলা থেকেই ভয় বা বিশ্বাস কোনোটাই ছিল না। তবু আমি স্বীকার করছি, কোনো-কোনো জায়গায় গেলে আমার গায়ে কাঁটা দেবেই দেবে। তিনবারের কথা মনে আছে, জ্বর হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। একবার তো মরতে মরতে বেঁচে গেছি মশাই।”
গদির মালিককে বলতে দিতেই হয়। কামাখ্যা মন্দিরের গল্প চাপা পড়ে যাওয়ায় সেই ভদ্রলোক চুপ করে গেছিলেন। তাঁকে দিয়ে আর বলানো গেল না। বড্ড লোকের ভিড় এই গদিতে। দু-দণ্ড বসে কথা কওয়া যায় না। তবু সপ্তাহে একদিন করে আসতে হয়।
যিনি কথা বলছিলেন, তিনি ধানচালের কারবারি। মাঝে মাঝে যেতে হয় ওঁর আড়তে ইস্কুলের বাচ্চাদের জন্য মিড-ডে মিলের চাল কিনতে। দেখেশুনে না নিলে আজেবাজে চাল গছিয়ে ইস্কুলের সঙ্গে মাস্টারের বদনাম। এসে বসে থাকি ঘণ্টা দুই। গরানহাটার বঙ্কুবাবু আর সনৎবাবুও আসেন একই কারণে। গুলতানি হয় কিছুক্ষণ। ওখানেই কথা হচ্ছিল।
কথাটা শুরু করেন বঙ্কু সান্যাল। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে গেলে নাকি ওঁর গায়ে কাঁটা দেয়। পরে ওখানেই দেয়ালে চুনের আস্তরণের তলায় গাঁথা এক সাড়ে ছ’ফুট লম্বা এক মানুষের কংকাল পাওয়া যায়। সেটা ওখানকার লোকেদের মতে শ্রীচৈতন্যদেবের কংকাল হতে পারে। যারই হোক, খুন হয়েছিল মন্দিরের ভেতরেই। পাণ্ডাদের হাতেই হয়েছিল খুন আর লাশ গুম করা। এখনও পুরিতে পাণ্ডাদের গুণ্ডামি দেখলে কথাটার সার সত্য আন্দাজ করা যায়। বঙ্কুবাবু তারপর থেকে পুরী বেড়াতে গেলেও মন্দিরের দিকে যান না। পাণ্ডাদেরও পছন্দ করেন না। গপ্পের গোড়া জগন্নাথের অন্নভোগ।
আমার স্টকেও আছে ওইরকম কিছু অভিজ্ঞতা। হাইকোর্টে আমার পিসেমশাই ওকালতি করতেন। একবার দু-বার ছোটবেলায় তাঁর সঙ্গে গেছি হাইকোর্টে কোনও অনুষ্ঠানে। ওখানে বাথরুমে যাবার সময় খুব গা-ছমছম করেছিল আমার। লম্বা বারান্দা দিয়ে বাথরুম যাবার সময় পেছনে কারও নূপুর পায়ে হাঁটার শব্দ পেয়েছি। কাউকে দেখতে পাইনি। গা হিম হয়ে গিয়েছিল। তখন আমার কম বয়েস। পরে শুনেছি, ওখানেও ভূত আছে। সন্ধের পর ভয় পেয়েছে অনেকেই। এক অশরীরী মুসলমান খুনে গুণ্ডা নাকি রক্তমাখা ছোরা হাতে দেখা দেয় রাতের অন্ধকারে। মালঘরের লোহার আলমারির ওপর বসে পা দোলায় সে। ফাঁসি হয়েছিল তার বহুবছর আগে ইংরেজ আমলে। ছোরাটা নাকি মালঘরের ভেতরে ডবল তালাবন্ধ অবস্থাতেই আলমারির ভেতরে মাঝে মাঝে রক্তে ভিজে যেত। মালঘর হল এমন জায়গা যেখানে খুনের বা অন্য অপরাধের একজিবিট রাখা থাকে। রক্তমাখা জামাকাপড়, অস্ত্রশস্ত্র, বিষের কৌটো, গুলিবারুদ জাতীয় জিনিসপত্র ইত্যাদি। একা ও-ঘরে যায় না কেউ।
এরকম গল্প হতে হতে আরও দু-তিনজন লোক জুটে গেল। তারাও বলল নানারকম। গা-ছমছম নয়, সরাসরি ভূতের গপ্পের দিকে চলে গেল ব্যাপারটা। গ্রামের লোকজন সব—কী দেখতে কী দেখেছে। প্রবল কুসংস্কার ওদের মনে। উঠে আসব কি না ভাবছি, গুছাইতবাবু লম্বা গল্প শুরু করলেন। প্রদীপ গুছাইত এই চাল দোকানের মালিক। লেখক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীর নাম শুনে বসে গেলাম। উনি যে ভালো মিডিয়াম সেটা চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। অবশ্য কার ভেতর কী আছে চেহারায় তা বোঝা যায় না। কালো, রোগা, বেঁটেখাটো মানুষটা। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে গামছা চাপিয়ে বসে আছেন গদিতে। চোখ দুটো শুধু ভাসা ভাসা। বয়েস হয়েছে। মুখে অজস্র বলিরেখা। পরিষ্কার করে গোঁফদাড়ি কামানো।
প্রদীপবাবু শুরু করলেন।—
আমার যে ভূতে বা ভগবানে খুব একটা বিশ্বাস নেই বলেছি। সামনাসামনি কিছু না দেখলে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না। অবশ্য কৌতূহল নেই বলব না। অবসর পেলে গল্প শুনতে আর পড়তে ভালোবাসি। তাছাড়া এত লোক বিশ্বাস করে যখন, কিছু না কিছু নিশ্চয়ই আছে। আমার বেশ কয়েকবার রোমাঞ্চ বা গায়ে কাঁটা দেবার ঘটনা ঘটেছে। বীরভূমে ইছাই ঘোষের দেউল আছে জানেন তো? মঙ্গলকাব্যের মহাযোদ্ধা ইছাই ঘোষ। ওখানে নির্জনে জঙ্গলে বসে ভয়ংকর লড়াইয়ের শব্দ পেয়েছিলাম। অস্ত্রের ঝনঝন, মানুষের মরণ আর্তনাদ, ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে ভয় পেয়েছি। জ্বরে ভুগেছি এক সপ্তাহ—সে অন্য গল্প। কোথাও কেউ নেই অথচ ওই শব্দ হতে শুনেছি নিজের কানে। ভয় তো পাবই। পরে বলা যাবে সে গল্প। অন্য ঘটনা বলছি শুনুন। এমন ভয় আমি জীবনে পাইনি।
আমার তখন তিরিশ বছর বয়েস। বছর আষ্টেক সওদাগরি জাহাজে চাকরি করে কিছু টাকা জমিয়ে ব্যাবসা করার কথা ভাবছি। বাবা তখনও বেঁচে। এই পারিবারিক ব্যাবসা সামলান একাই। বললেন সুন্দরবনে আমাদের জমিদারিটা দেখে আসতে। আমাদারে হাটগাছার কাছে কুন্তী নদীর ধারে বাড়ি। অনেকটা চাষের জমি। এছাড়া বিশাল আমবাগান। এর পরেও বাবা সুন্দরবনের লাট অঞ্চলে বেশ বড়ো জমিদারি কিনেছিলেন। দুটো নৌকোও ছিল ওখানে যাতায়াতের জন্য। একটা কাছারি বাড়ি ছিল। ওখানেই জমিয়ে বসলাম। এ প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা মশাই। সে এক ফাঁড়া গেছে।
দুটো আলাদা ব্যাবসা ছিল আমার সুন্দরবনে। ওখানে মাটির গভীরে নোনা কাঠ পাওয়া যায় অনেক। জলে ডুবিয়ে রাখলে নষ্ট হয় না। নোনা জল আর মাটিতে অদ্ভুত অষ্টাবক্র চেহারা হয় সেগুলোর। ওখানকার লোকেরা এই কাঠ কয়লার মতো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলেও আমি ওগুলো নিউমার্কেটে ভালো দামে বিক্রি করতাম। শৌখিন লোকেরা ওই দিয়ে ঘর সাজায়, অ্যাকোয়ারিয়ামে রাখে। বেশ ভালো চলছিল ব্যাবসাটা। আমিই পাইওনিয়ার। আর একটাকে ব্যাবসা না বলে শখ বলা যায়। মাটির তলা থেকে খুঁড়ে প্রত্নসামগ্রী খুঁজে বার করা। বনের বাছাইকরা জায়গায় মাটি খুঁড়ে দেখতে হত। সব জায়গায় পাওয়া যেত তা নয়। নৌকো করে দলবল নিয়ে চলে যেতাম। রাতে গাছের ওপর মাচা বেঁধে থাকতাম কোনো-কোনো সময়। ক্যামেরায় ছবি তোলার নেশাও ছিল। আমি চলে আসার অনেক পরে সরকারি আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট ওখানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। বেহালার মিউজিয়ামে গেলে দেখতে পাবেন ওখানে খুঁজে পাওয়া অনেক প্রাচীন প্রত্ন-জিনিস। আমিও পেয়েছি অনেক, বেশিরভাগই দিয়েছি মিউজিয়ামে। ওটা ছিল শখ, ব্যাবসা নয়। নেশাও বলতে পারেন।
হাজার হাজার বছর আগেও সুন্দরবন অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল—জানেন তো? তখন এর নাম ছিল সমতট। এটাই ছিল বাইরের দেশ থেকে বাংলায় ঢোকার আসল পথ। বড়ো বড়ো জাহাজে বাঙালিরাও বিদেশে বাণিজ্য করতে যেত। এখানে কত বন্দর, বড়ো বড়ো বাড়ি, মন্দির এসব ছিল। তারপর ঝড়, বন্যা, যুদ্ধ আর মহামারীতে সব উজাড় হয়ে জঙ্গল আর বুনো জানোয়ারের থাকার জায়গা হয়েছে এখানে। ভয়ংকর পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয় যোদ্ধারা থাকত এখানে। আর ছিল বারোভুঁইয়া।
আপনারা মাস্টারমশাই, বেশি বিদ্যে ফলাব না। মাটির তলায় পরতে পরতে লুকোনো আছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। ওটাই টানত আমাকে, গুপ্তধন নয়। সুজা, মগ, বর্গি, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজদের সঙ্গে লড়ত দুর্ধর্ষ বারোভুঁইয়া। রাজা প্রতাপাদিত্যের কয়েকটা দুর্গ ছড়িয়ে ছিল এই এলাকায়। ওদের হাতে হেরে যাওয়া বন্দি আর অপরাধীদের মারবার জন্য একটা মশান ছিল সুন্দরবনের একপ্রান্তে। জায়গাটার নাম ছিল মশানতলা। নাম শুনে কৌতূহল হলেও সেই জায়গাটা যে ঠিক কোথায় তা আমার জানা ছিল না। একদিন নৌকোয় যেতে যেতে বুড়ো জব্বার মাঝি নদীর বাঁকের কাছে ঘন জঙ্গলের মাঝে একটা স্তূপ দেখাল। তখন বিকেল মরে এসেছে। বড়ো বড়ো গাছে আড়াল করা একটা মন্দিরের চূড়া আর পাশেই একটা ঘর নজরে পড়ল।
“এইখানে কেউ যায় না কর্তা। এরে কয় মশানতলা। ভয় পায় লোকে। দিনেও নামে না।”
“ভয় পায় কেন? কী আছে ওখানে?”
“এখানে কয়েদিদের মাথা কাটা হত। শূলেও দিত। মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলত মাথাটুকু বাইরে রেখে। বাঘ আর শেয়ালের খাওয়ার জন্য। জানোয়ারেরা নরখাদক হয় এই কারণে।”
“কারা করত এটা?”
“অনেক আগে থেকেই চালু ছিল মশান। তারপর আসে রাজা প্রতাপাদিত্যের লোকেরা। মেদন মল্লের নামও করে লোকে। এখনও ভাঙা গুমঘর আর মন্দির দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, আর আছে চারটে শূল। এখনও আছে।”
“তুমি জানলে কী করে? কেউ তো যায় না বললে।”
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে জব্বারচাচা কথা বলল শেষমেশ।—“কম বয়েসে একবার গিয়ে দেখে এসেছিলাম, পরে আর যাইনি।”
“কী দেখলে?”
তক্ষুনি কিছু না বললেও রাতে কাছারিতে ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর বলেছিল জব্বারচাচা। এক জায়গায় শয়ে শয়ে লোক ওইরকম যন্ত্রণা পেয়ে মরলে অতৃপ্ত আত্মারা কোথাও যাওয়ার জায়গা পায় না। বদ্ধ হয়ে থাকে। দিনের বেলাতেও ভয় দেখায়। নানারকম শব্দ শোনা যায়। ছদ্মবেশ ধরে কাছে আসে, নৌকোয় আশ্রয় চায়। চেনার উপায় থাকে না ভূত বলে। খুব চেনা মানুষ সেজেও আসে কোনো-কোনো সময়। ওদের চিনতে পারে মন্ত্রতন্ত্র জানা বাউলেরা। তবে কোনও ক্ষতি ওরা করতে পারে না মানুষের।
এরকম ভাসা-ভাসাভাবে বলেছিল জব্বারচাচা। ঠিক কী ঘটেছিল সোজাসুজি বলেনি। ও জানত আমি ভূত বিশ্বাস করি না। কিন্তু ওখানে গভীর বনে ঢাকা ধ্বংসস্তূপগুলো যে আমায় টানে এটা ও জানত। আমি যাতে মশানতলায় যেতে না চাই তাই ও বেশি কিছু বলতে চায়নি বলে মনে হল আমার। কিন্তু আমি ঠিক করলাম, ওখানে যাব তো বটেই, স্তূপ পরিষ্কার করে মাটি খুঁড়ে দেখব কিছু খুঁজে পাওয়া যায় কি না।
মাটি কাটার লোকজন আর একজন নামকরা বাউলেকে নৌকোয় তুলে রওনা হয়ে গেলাম মশানখালির দিকে। জায়গাটা বেশ দূরে। মোটামুটি তিন ভাটির পথ বলে যথেষ্ট চাল-ডাল-জল সব সঙ্গে রাখতে হয়েছে। সময়টা শীতকালের শুরু। বাঘের ভয় আছে আমার বন্দুক আর এক ব্যাগ গুলি সঙ্গে রেখেছি। রাতে খুব কুয়াশা পড়ে তাই পাঁচ ব্যাটারির একটা টর্চ আছে ব্যাগে। তবে ঘন কুয়াশায় টর্চে কাজ হবে বলে মনে হয় না। দু-হাত দূরেই নজর চলে না ওখানে। জানি না নরখাদক বাঘ এই কুয়াশা ভেদ করে কতটা দেখতে পায়। চাচা যায়নি আমার সঙ্গে। ওর ওপর কালীপুজোর সব কেনাকাটার দায়িত্ব। দু-দিন বাদেই কালীপুজো। যে-কোনো পালাপার্বণে চাচা আমাদের মুরুব্বি। শুধু রওনা দেবার দু-দিন আগে ও আমায় কাছে ডাকল।
“বলো চাচা?”
“পরশু যাস না কর্তা। দু-দিন পরে যা।”
“কেন গো? লোকজন বলা হয়ে গেছে।”
“দিনটা ভালো না কর্তা। ওরে বলে ভূতচতুর্দশী। তেনাদের দিন। ওইদিনটা পার করে কালীপূজার পরে যাও।”
“ওসব আমি মানি না গো চাচা। লোকের ভয় ভাঙা দরকার।”
জব্বারচাচা যাবার আগে আর একটা কথাও বলেনি। শুধু একটা তাবিজ রেখে দিয়েছিল আমার পকেটে, অজান্তে। কী জানি, হয়তো তাবিজটার জন্যই বেঁচে গেলাম সে-যাত্রা। আমার প্রত্নতাত্ত্বিক কৌতূহলেরও সেখানেই ইতি। বেশ বুঝেছি, ইতিহাস খুঁড়তে যাওয়া আমার মতো হাতুড়ের কর্ম নয়।
সেদিন শেষরাত থেকেই দারুণ কুয়াশা। রোদ ওঠার পর একটু নজর চলল। তাও দশ-বারো গজের পর সব সাদা। কমবয়সি জনা চারেক মাঝি আর ছ’জন মাটি কাটার সাঁওতাল মেটেল। তার সঙ্গে আমি আর বাউলে হরিনাথ মৃধা। সব বেশি পয়সা কবুল করে রাজি করানো। রওনা দেবার পর নৌকো বেশ সাবধানে চালাতে হচ্ছিল। হাঁকডাক করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে দিতে যাওয়া—যে-কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
শেষে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটিয়েই মশানখালি দ্বীপে নামতে বিকেল হয়ে গেল। ওখান থেকে হাঁটাপথে মশানতলা সিকি মাইলটাক। হরিনাথের চেনা জায়গা। ওখানে ট্যাঁকের বা বাঁকের মুখে নদীতে স্রোতের পাক থাকায় নৌকো রাখা যায় না। সমুদ্রের কাছে বলে জলের টান খুব বেশি।
জল থেকে আট-দশ ফুট উঁচু করে পুরোনো পাতলা ইটের বাঁধানো পাড় ধ্বসে গেছে ট্যাঁকের শেষ অংশ, তবু বাকি পাড় ভাঙেনি। বড়ো বড়ো বট, অশ্বত্থ, নিম আর বেলগাছের মাঝখানে পোড়ো মন্দির বহুকালের ঝোপঝাড় আর সোনালতায় ঢাকা পড়ে আছে। পাশে বিশাল একটা কুয়ো বা ইঁদারার ভাঙা স্তূপ।
ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করতে করতে দিনের আলো কমে এল। কুয়াশাও ঘন হয়েছে ততক্ষণে। হঠাৎ আমার পা বিচ্ছিরিভাবে গেল মচকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভয়ংকরভাবে ফুলে উঠল জায়গাটা। পা নাড়াতেই পারছি না। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। ঠিক করলাম তাড়াতাড়ি একটা মাচা বেঁধে রাতটা ওখানেই কাটাব। আমার সঙ্গে থাকবে বাউলে হরিনাথ, বাকিরা চলে যাবে নৌকোয় রাত কাটাতে। একটা ব্যাপার—এখানে সাপ বা বাঘের থাকার খোঁচ চোখে পড়েনি। সরঞ্জাম সঙ্গে ছিল। এতগুলো হাতে চটপট বেশ চওড়া মাচা বাঁধা হয়ে গেল প্রায় কুড়ি ফুট ওপরে। রাতে খাওয়ার জন্য ভাত-মাংস হাঁড়িতে রেখে ওরা আমাকে ধরাধরি করে মাচায় তুলে নৌকোর দিকে চলে গেল। সঙ্গে রইল টর্চ আর বন্দুকটা। হরিনাথ ওদের পাঠিয়ে দিয়ে এলাকাটার চারদিকে গণ্ডি কেটে গাছ বেয়ে মাচায় উঠে এল। ততক্ষণে দিনের আলো চলে গিয়ে অমাবস্যার ঘন অন্ধকার। পায়ের ব্যথায় কম্বল মুড়ি দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। হরিনাথ একপাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে রইল। লোকটা কথা কম বলে, আমারও ব্যথায় কথা বলার শক্তি বা মেজাজ নেই। রাত বাড়তে লাগল।
প্রায় তিন মানুষ উঁচুতে বাঁধা মাচাটা বেশ বড়ো। ওপরে মোটা পলিথিনের চাদর টানটান করে বাঁধা শিশির আটকানোর জন্য। দিন সাতেক ওখানে আরামেই কাটানো যাবে, কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। আশা করি পায়ের ব্যথাও কমে যাবে ততদিনে।
নির্জনতা ভালোবাসি আমি। রাত বাড়ছে। জোয়ারের স্রোতের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুম পাচ্ছে, দু-চোখ জুড়ে আসছে। বাউলে হরিনাথ লোকটা কথা বলেই না প্রায়। বসেই আছে একভাবে। বোধহয় বসে-বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আবছা মন্দিরটা একটু নজরে পড়ছে কুয়াশা ভেদ করে। দূর থেকে রাতচরা প্যাঁচার ডাক কানে আসছে আর বাদুড়ের ডানার ঝটাপটি। বহুদূর থেকে যেন বাঘের গর্জন কানে এল দু-তিনবার। ঘন কুয়াশায় দেখা না গেলেও বহুদূরের শব্দ শোনা যায়। ডাক শুনলেও কতদূরে বাঘটা আছে আন্দাজ করা যায় না। এই অন্ধকারেও কী করে হালকা নীচেটা দেখতে পাচ্ছি কে জানে। নদীর লোনাজলের ফসফরাস, না তারা আলো? কে যেন বলেছিল, বনের মধ্যে তারার আলোয় হালকা নজর চলে।
রাতের খাওয়ার পর গাছের নীচে যেন শেয়ালের আনাগোনার আওয়াজ পেলাম। ঘুম আসছে না, শুয়ে আছি চোখ বুজে। হরিনাথ বসেই আছে চুপচাপ। বোধহয় মন্ত্র জপছে একমনে। অদ্ভুত দায়িত্বজ্ঞান লোকটার।
হঠাৎ চটকা ভেঙে গেল আমার। সারা শরীরে কাঁটা দিয়েছে। হাত চলে গেছে বন্দুকের দিকে। খুব ঝাপসা ছবির মতো নীচে এ কী দেখছি! কে যেন একটা মশাল জ্বেলে দিয়েছে বটগাছটার গোড়ায়। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে, পাশাপাশি চারটে শূলে চারটে মানুষ গাঁথা অবস্থায় ছটফট করতে করতে নেতিয়ে পড়ল। শূলের তলায় চারদিকে শ্বাসমূলগুলো যেন মানুষের হাতের মতো মাটি থেকে উঠে আসছে। হাত নয়, সাদা সাদা হাতের কংকাল! আমি চিৎকার করবার চেষ্টা করেও গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের করতে পারলাম না। হরিনাথ কোথায় গেল? কোথায় হরিনাথ! গা থেকে চাদর ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে একটা কংকাল। হাতে তার খড়গ! তারপর আর আমার জ্ঞান ছিল না। সকালে ওরা এসে আমায় নামায় মাচা থেকে। হরিনাথ পড়ে ছিল বটগাছের গোড়ায় অজ্ঞান অবস্থায়। ওর জ্ঞান আর ফেরেনি। সাত-আটদিন জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিলাম আমি। বাঁচার আশা ছিল না। বোধহয় তাবিজের জন্যই বেঁচে গেলাম। মশানতলায় আর যাইনি কখনও।
ছবি: পুণ্ডরীক গুপ্ত
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের অসামান্য লেখায় ও আঁকায় কিশোর গল্প সংকলন।
গুণময় রায় বিজ্ঞানী মানুষ। নিজের পরিচয় দেন ‘ইনভেনটর’ বলে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও তুখোড়। আবার ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস এবং পুরাতাত্ত্বিক বিষয়েও তাঁর গভীর জ্ঞান। কখনও নিজের মনোজগত, কখনো-বা প্রজন্মবাহিত স্মৃতির সরণিতে অক্লেশে ঘুরে বেড়ান ‘গুণময় দ্য গ্রেট’, আর পাঠকেরাও সুযশ মিশ্রের জবানিতে স্বাদ পায় সেই অতুলনীয় অ্যাডভেঞ্চারগুলির।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী