15% OFF * FREE SHIPPING
সমৃদ্ধি ব্যানার্জী (১২)
এখন অনেক রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। আমি চেয়ারে বসে বসে ঢুলছিলাম, হঠাৎ কী একটা অস্বস্তি হতে ঘুমের রেশ কেটে গেল। আমি লাঠি হাতে উঠে দাঁড়ালাম। যাই, একবার গ্যালারির মধ্যে ঘুরে আসি।
সকাল থেকে সন্ধে অনেক লোকেরই ভিড় হচ্ছে এই আর্ট এক্সিবিশনে। রাতে সব সুনসান। শুধু আমি একা জেগে রয়েছি। আমার নাম সন্তু। আমি এখানে নাইট গার্ড হিসাবে কাজ করছি।
পিকচার গ্যালারি ঘুরে এবার স্কাল্পচার গ্যালারির কাছাকাছি এসেছি। কেমন একটা ঠকঠক শব্দ হচ্ছে না? দেখতে হবে এখনই।
স্কাল্পচার গ্যালারিতে ঢুকে দারুণ ভয়ে আর বিস্ময়ে আমার প্রায় দম আটকে এল। এ আমি কী দেখছি! একটা পাথরের মূর্তি আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছে! তারই পায়ের শব্দ হচ্ছে ঠকঠক।
আমি চিৎকার করে উঠলাম—“কে ওখানে?”
বলেই দেওয়ালের সুইচ বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম বড়ো আলোটা জ্বালব বলে। রাতে এখানে বড্ড কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে।
সুইচ টেপার আগেই আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। মূর্তিটা দুই হাত তুলে কেমন ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল, “প্লিজ প্লিজ, আলো জ্বালবেন না। আমি ভূত নই, মূর্তি নই—আমি মানুষ।”
আমি এবার ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটার একটা হাত চেপে ধরলাম। নিশ্চয়ই এ চোর, গায়ে মূর্তির মতো রঙ মেখে এখানে ঢুকেছে। কিন্তু লোকটাকে ছুঁয়ে আরও অবাক হলাম। এর হাত পাথরের মতোই শক্ত। মানুষের মতো নয়!
লোকটা বলল, “তুমি অবাক হচ্ছ, তাই না? এসো, এখানে বসে তোমায় সবটা বলছি। আর্টিস্ট সুবীর বসু শুধু একজন আর্টিস্ট নন, কেমিস্ট্রিতেও খুব দক্ষ। উনি এমন একটা ওষুধ আবিষ্কার করেছেন যেটা খাওয়ালে মানুষের শরীর পাথর হয়ে যায়।”
আমি চিৎকার করে উঠলাম—“আপনাকে এরকম ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে?”
ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ। আমি তাঁর সেক্রেটারি ছিলাম। এর আগে দু-তিনজন গরিব লোককে খাবারের লোভ দেখিয়ে তিনি এই ওষুধ খাইয়ে পাথরের মূর্তি বানিয়ে অনেক দামে বিদেশে বিক্রি করেছেন। আমি বাধা দিতে গেছিলাম, তাই আমাকেও খাইয়ে মূর্তি বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এটা উনি জানেন না যে আমি পুরোপুরি পাথর হইনি। আমি ছটফট করায় অনেকটা ওষুধ ঠোঁটের পাশ দিয়ে বাইরে পড়ে গেছিল। এখন আমার এমন অবস্থা যে আমি কোনও উজ্জ্বল আলোতে কথা বলতে বা নড়াচড়া করতে পারি না। শুধু অন্ধকারেই একটু একটু পারি।”
আমি সব শুনে অবাক। রাগও হচ্ছিল খুব। বললাম, “স্যার, আমাদের এই সুবীর বসুকে ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। আমি পুলিশে ফোন করছি। আপনি তাঁদের সবকথা বলুন।”
তখন প্রায় ভোর হয়ে আসছে। পুলিশ ইন্সপেক্টর অমর সেনের জিপে উঠে আমরা পৌঁছে গেলাম সুবীর বসুর বাড়িতে। বাড়ির বেসমেন্টের একটা ঘরে ওঁর ল্যাব। ওঁর বাড়ির দারোয়ান আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পুলিশের সামনে তার কিছু করার ছিল না।
আমরা ল্যাবে পৌঁছে দেখি সাংঘাতিক কাণ্ড! একটা বাচ্চা মেয়েকে ওই ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন সুবীর বসু। মেয়েটা ছটফট করছে।
ইন্সপেক্টর সেনের রিভলভারের গুলি সোজা গিয়ে লাগল সুবীর বসুর হাতে। ওষুধ আর খাওয়ানো হল না, তিনি হাত চেপে ধরে বসে পড়লেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।
মূর্তি হয়ে যাওয়া ভদ্রলোক এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। আর আমার কিছু করার নেই। এই পাথরের জীবন আমি আর চাই না। আমি মুক্তি চাই।”
কেউ কিছু বোঝার আগেই উনি একটা কাচের শিশি টেনে নিয়ে তার মধ্যে কী একটা নীল তরল ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর পাথরের শরীর ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে গেল।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। আমি আজও সেই ঘটনা ভুলতে পারিনি। সেই সেক্রেটারি ভদ্রলোকের জন্য ভারি খারাপ লাগে। তবে দোষীর শাস্তি হয়েছিল—এটাই আনন্দের কথা।
বহু কলমের গল্পে, প্রবন্ধে, সত্যি ঘটনায়, তথ্যে, গ্রাফিক নভেলে প্রাইমেটদের হাজারো কাণ্ড।
শুভাঞ্জন ব্যানার্জ্জী (১৪)
“আচ্ছা, তোরা কেউ ভূতে বিশ্বাস করিস?”
অতীনের প্রশ্নটা শুনে আমরা মুহূর্ত খানেকের জন্য থমকে গেলাম।
আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে সারাদিন। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি থেমে গেলেও প্রবল বেগে হাওয়া বইছিল। আমি আজ বাড়িতে একাই ছিলাম। মা-বাবা মামাবাড়ির উদ্দেশে সকালেই গাড়িতে রওনা হয়ে গেছে। দিদুনের শরীরের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। মামাও এখন কাজের সূত্রে বাইরে। মামি ছাড়া দিদুনকে দেখার মতো কেউ নেই। আমারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দু-সপ্তাহ পর অ্যানুয়াল পরীক্ষা, তাই যেতে পারলাম না। মা অবশ্য একা রেখে যেতে চাইছিল না। শেষে বাবা বোঝানোর পর নিমরাজি হয়েছে। যদিও বেরোবার আগে আমাকে পইপই করে প্রত্যেকটা কথা অন্তত দশবার করে বলে দিয়েছে। যেমন সন্ধ্যাবেলা ঘর থেকে না বেরোতে, বৃষ্টির ছাঁট এলে জানালা বন্ধ করে দিতে ইত্যাদি। আমি মাথা নেড়েছি শুধু। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা পড়াশুনো করার পর একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু গল্পে মন বসছিল না। তাই অতীন আর সুমিতকে ফোন করে ডেকে নিলাম। ওরা আমার বন্ধু। আমরা তিনজনেই এক পাড়ায় থাকি।
নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা চলার মাঝে হঠাৎ অতীনের এই প্রশ্নে আমরা থমকে গেলাম। প্রশ্নটাই এমন।
“কী রে, বল!”
সুমিত উত্তর দিল, “নাহ্, ভূত বলে কিছু নেই। আমি অন্তত মানি না।”
“ভগবানে বিশ্বাস করিস?” অতীন জানতে চাইল।
“তা করি।”
“তাহলে ভূতে বিশ্বাস করিস না কেন? দুটোর সঙ্গেই তো অলৌকিক ব্যাপারটা জড়িয়ে আছে।”
“তা হলেও ভূতে আমার বিশ্বাস নেই।” একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল সুমিত।
“কেন?”
“সে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না।”
“ঠিক আছে। এখুনি প্রমাণ হয়ে যাবে ভূত আছে কি নেই। কিন্তু তার আগে অতনু বল, তুই ভূতে বিশ্বাস করিস?”
“আমি যে অবিশ্বাস করি এমন বলতে পারি না। আবার বিশ্বাস করি না এমনও বলতে পারি না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি আমি।” মৃদু হেসে বললাম আমি।
“ওকে। তাহলে একটা কাজ করলেই হয়। তখন প্রমাণ হয়ে যাবে, ভূত আছে কি নেই।”
সুমিত ভয়ে ভয়ে বলল, “তুই প্ল্যানচেটের কথা বলছিস না তো?”
“ঠিক ধরেছিস।” হেসে বলল অতীন।
“না না, ওসব ছেলেবেলার জিনিস নয়। ওসব দিকে না ঘেঁষাই ভালো।”
“কেন? ভয় পেয়ে গেলি নাকি?” অতীন মজা পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল সুমিতকে।
“ধুস! ভয় কে পাচ্ছে? বাড়িতে বড়োরা কেউ নেই। এখন এসব করা ঠিক নয় ভেবেই বারণ করছিলাম। আমার কোনও আপত্তি নেই। অতনুকে জিজ্ঞাসা কর।”
“কী রে অতনু, তোর আবার কোনও আপত্তি নেই তো?”
“না না, ভালোই তো। বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে।”
মনটা খচখচ করলেও সায় দিলাম। তা না হলে আমাকেও ভিতু বলে খ্যাপাবে। অতীনটা বরাবরই এইরকম। কোনোকিছুর তোয়াক্কা করে না। ভয় শব্দটা ওর অভিধানে নেই।
তবে এ-কথা বলার পর আমি মৃদু গলায় বললাম, “মান্টুদা থাকলে আরও ভালো হত।”
ওরা দুজনেই আমার কথায় সায় দিল। অতীন বলল, “ঠিক বলেছিস। মান্টুদা তো ইদানীং পারলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে চর্চা করছে। মান্টুদা থাকলে ব্যাপারটা আরও জমত।”
সুমিত বলল, “আমি ওর বাড়িতে ফোনও করেছিলাম। কাকিমা ফোন তুলে বললেন যে, মান্টুদা কী একটা জরুরি কাজে শহরের বাইরে গেছে। ফিরতে নাকি অনেক রাত হবে।”
মান্টুদা আমাদের পাড়াতুতো দাদা। আমাদের তিনজনকেই খুব স্নেহ করে। একেবারে নিজের ভাইয়ের মতো। মান্টুদার আসল নাম মাধব চৌধুরী। আমরা ডাকি মান্টুদা। যদিও মান্টুদা নামটা তার একদম পছন্দ নয়। মান্টুদা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। তবে বিজ্ঞানের বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসে। তার ঘরের একটা দিকে জুড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি বুক-শেলফ। তাতে রাজ্যের বই ঠাসা। তার মধ্যে গল্পের বই যেমন আছে, তেমনই রয়েছে অদ্ভুতুড়ে বিষয় নিয়ে সরস ও নীরস—উভয়রকম প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। এছাড়াও আরও অনেক বিষয়ের বইপত্র সেখানে মজুত আছে। মান্টুদা বই পড়তে ভালোবাসে। আমরাও মাঝে মাঝে মান্টুদার থেকে বই ধার করে এনে পড়ি। যদিও তার বেশিরভাগই আমাদের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। মান্টুদা অবশ্য বই ফেরত দিতে যাওয়ার দিন আমাদের মুখ-চোখ দেখেই বুঝে যায় বইটা নিয়ে আমাদের কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। যদি খারাপ হয়, তাহলে মান্টুদা আমাদের সেই বিষয়টা সহজ করে এমনভাবে বুঝিয়ে দেয়, তখন নীরসটাই সরস হয়ে ওঠে।
এমনই আমাদের মান্টুদা।
অতীন বলল, “চল। প্ল্যানচেট করা যাক। দেরি করে লাভ নেই।”
আমরাও তার কথায় সায় দিলাম।
আমরা এতক্ষণ একটা গোল টেবিল ঘিরে বসে ছিলাম। তার মাঝখানে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হল। তারপর দরজায় ছিটকিনি তুলে ঘরের আলো নিভিয়ে দিতেই নিকষ কালো অন্ধকারে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম আমরা। এরপরে ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসতে দেশলাই কাঠি জ্বেলে মোমবাতি জ্বালল অতীন।
সুমিত কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “এখনও ভেবে দেখ কিন্তু।”
“তুই একটু চুপ করবি?”
সুমিত সত্যিই চুপ করে গেল। আর কোনও কথা বলল না।
আমরা তিনজন টেবিল ঘিরে বসলাম। ইতিমধ্যে আমি একটা নোটবুক আর পেন রেখে দিয়েছি টেবিলের উপর।
অতীন বলল, “কাকে স্মরণ করা যায়?”
সত্যিই তো! এ-কথা তো ভেবে দেখা হয়নি।
আমি বললাম, “ঠিকই তো।”
অনেক ভেবেও আমরা কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। মেঘের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে চাঁদ। জানালা দিয়ে স্নিগ্ধ নরম আলো এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে। আমরা তিনজনেই চুপচাপ বসে আছি। একসময় নিস্তব্ধতা ভেঙে অতীনই বলে উঠল, “ঠিক আছে, এক কাজ করা যাক। আমরা মন দিয়ে কাউকে একটা ডাকার চেষ্টা করি, যাকে আমরা তিনজনেই খুব ভালোবাসি। চেষ্টা করে দেখি, নিশ্চয়ই কেউ আসবে।”
আমরা অগত্যা তার কথায় সম্মতি দিলাম।
এরপর চোখ বন্ধ করে আমরা সেইমতোই স্মরণ করতে লাগলাম। আমার অবশ্য সন্দেহ ছিল, এমন উদ্ভট পদ্ধতিতে প্ল্যানচেট হয় কি না। তবুও এ-ছাড়া যে আর কোনও উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়েই ডেকে যেতে লাগলাম কাউকে। কেন জানি না, মান্টুদার মুখটাই ভাবতে ভাবতে মাথায় এল। এতে অবাক হলেও কোন এক অজানা কারণে চোখ খুলতে পারলাম না। মান্টুদার কথাই ভেবে যেতে লাগলাম। ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছি। একসময় মনে হল চারপাশে কেউ নেই। শুধু আমি একা, এক মনে শুধু ভেবে চলেছি মান্টুদার কথা।
হঠাৎ টেবিলটা নড়ে উঠল। থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি চমকে চোখ খুলে ফেললাম। দেখলাম, কেঁপেই যাচ্ছে টেবিল। সুমিত আর অতনুও চোখ খুলেছে। ওদের মুখও ফ্যাকাসে মেরে গেছে। একটুক্ষণ কেটে গেল। একসময় কাঁপতে কাঁপতে টেবিলটা স্থির হয়ে গেল। বাইরে থেকে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে মোমবাতির শিখাটাকে মৃদু কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে গেল। আমার গায়ে কেন জানি না কাঁটা দিয়ে উঠল। আমরা তিনজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বসে আছি। কেউ কথা বলতে পারছি না।
কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। চারপাশ একেবারেই নিস্তব্ধ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। আর এর পরেই আমাদের চমকে দিয়ে কে যেন দরজার ঠকঠক করতে লাগল। আমরা চমকে উঠলাম। একটা হিমশীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। দরজার অন্যপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি যেন অধৈর্য হয়ে উঠেছে বড়োই। জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে চলেছে দরজায়।
সুমিত বলে উঠল, “কে রে এত রাতে?”
“ধুত! বড্ড বাজে বকিস তুই। ভিতুর ডিম কোথাকার!” বলতে গিয়ে অতনুর গলাটাও কেঁপে গেল।
বুঝলাম, ও ভয় পেয়েছে। সুমিতের উপর রাগ দেখিয়ে ভয়টাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। একটু থেমে বলল, “দাঁড়া। তোরা বস। আমি দেখছি।” বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অতীন।
দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই আমি বললাম, “অতীন!”
তারপর সম্ভবত ভয়টাকে ঝেড়ে ফেলার জন্যই জোর করে হেসে উঠল অতীন। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল এরপর। একটা লম্বামতো লোক ঘরে ঢুকে এল। তার পরনে বর্ষাতি। তা থেকে টুপটুপ করে জল ঝরে পড়ছে।
আমি তার মুখ দেখতে পেয়েই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম, “মান্টুদা!”
“হ্যাঁ রে, আমি।” মান্টুদার গলাটা কেমন যেন খসখসে শোনাল।—“তোদের খুব জরুরি একটা কথা বলতে এলাম। আমি চলে গেলে আমার বইগুলোর যত্ন রাখিস। নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিস। তা না হলে যে আমি মরেও শান্তি পাব না রে।” এই বলে মান্টুদা যেমন এসেছিল, তেমনই চলে গেল।
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম ব্যাপারটা নিয়ে। কেউই বুঝলাম না কথাগুলোর মানে। কিছুক্ষণ টুকটাক গল্প করার পর ওরা চলে গেল।
হঠাৎ দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ! দরজা খুলে দিতেই দেখলাম বাবা-মা দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে দিতেই ভিতরে ঢুকে এল ওরা।
“খবরটা শুনেছিস?” বাবা জিজ্ঞাসা করল।
“কী?”
“মান্টু মারা গেছে।”
“সে কি!” আমি চমকে উঠলাম।—“একটু আগে যে…” বলতে গিয়েও চেপে গেলাম।
“হ্যাঁ, কোনও কাজে গিয়েছিল। বিকেলে একটা অ্যাক্সিডেন্টে—স্পট ডেড। এই তো ফেরার সময় দেখলাম বডি এসেছে।”
মা বলে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও কথাই আর আমার কানে ঢুকছে না। মনের মধ্যে দুঃখ আর বিস্ময় তালগোল পাকিয়ে গেছে। শুধু ভাবছি, যে এসেছিল সে কি তবে সত্যিই মান্টুদার...
হেরম্বপুর থানার দোর্দণ্ডপ্রতাপ দারোগা দিগম্বর দিকপতি। রগচটা, বদমেজাজি, কিন্তু কর্মনিষ্ঠ। যাঁর দাপটে অপরাধ-জগৎ কম্পমান! সেই দিকপতিকে তিষ্ঠোতে দেয় না ধুরন্ধর চোর সনাতন। নানান ভাবে, নানান ফিকিরে নাস্তানাবুদ করে তোলে দাপুটে এই বড়োবাবুকে। অকুতোভয় বড়োবাবু বাইরে প্রকাশ না করলেও মনে মনে সনাতনকে খুবই ভয় পান। কী জানি কখন কী করে ব্যাটাচ্ছেলে তাঁর মানসম্মান সব ধুলোয় মেশায়! সবসময়ই বাছাধনের মাথায় শুধু বুদ্ধির মারপ্যাঁচ! তাই সর্বদাই তাকে সমঝে চলতে হয়।
অপরদিকে সনাতনেরও দারোগাবাবুর ভয়ংকর বদমেজাজি রাগটাকে ভয়। কে জানে কবে তাকে মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে যাবজ্জীবন সাজায় না জেলে পাঠান! সমস্ত বই জুড়ে শুধু এই দুই মহারথীর দ্বৈরথ।
কখনও সনাতন শেষ হাসি হাসলে কখনও দিকপতিও জয়ী হন। শুরু থেকে শেষ অবধি এই সংকলনের কুড়িটি গল্পে শুধু অত্যন্ত মজাদার এই দুই চরিত্রের অদম্য লড়াই। পাঠক হাসিতে লুটিয়ে পড়বেন কাহিনির বিন্যাসে। সঙ্গে সনাতনী সংলাপ আর দিগম্বরী প্রত্যাঘাত।
সুহেনা মন্ডল (১১)
সকালবেলা কিছু বুঝলাম না, কেন সবাই এইরকম আচরণ করছে? সকাল থেকে একটার পর একটা মাঝে ফুটোওয়ালা গোলাকার দেখতে জিনিস—সিডি না কী যেন বলে, সেগুলো একটা মেশিনের মধ্যে রাখছে আর গান শুনছে। ক্যালেন্ডার দেখলাম কোনও কিছু দেখাচ্ছে কি না। ডিজি ক্যালেন্ডার বলল—আজ একশো বাষট্টিতম জন্মদিন শ্রী আর. ঠাকুরের।
কে এই আর. ঠাকুর? এই জিজ্ঞাসা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটল। অবশ্য টিভিতে আজ যে কার্টুনগুলো দেখাচ্ছে—যেমন তাসের দেশ, কাবুলিওয়ালা ইত্যাদি, সেগুলো খুবই মজার ও ভালো। কে লিখেছে এগুলো? আমি ভাবলাম। ভাবছি বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করব এই আর. ঠাকুরের ব্যাপারে। কিন্তু এ কী? সবাই এটা কী করছে? কী সুন্দর একটা নৃত্যনাট্য হচ্ছে—নাম ‘চিত্রাঙ্গদা’।
“ভালো লাগে দেখে যে আমাদের বাচ্চারাও কবিগুরুর সেবায় মগ্ন।” বলল দাদু-ঠাম্মি।
“কে এই কবিগুরু, ঠাম্মি?” নীচু স্বরে বললাম আমি।
“সময় চলে এসেছে, কবিগুরু সম্পর্কে তোমায় বলব।” বলল ঠাম্মি।
তারপর ঠাম্মি জানাল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্কে। সেই থেকে আমার মন এক সাহিত্য ও সংগীতময় দুনিয়ার খোঁজ করতে চাইল। আমাদের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয় রবি ঠাকুরের জন্মদিনে আমি তখনই একটা কবিতা লিখলাম ওঁকে শ্রদ্ধা জানাতে।
একশো বাষট্টিতম জন্মদিন,
বয়ে চলেছে সময়,
সবার হৃদয়ের অন্তরে
শুধু কবিগুরুই রয়।
সেটা পাঠও করলাম।
“দেখলি ঘোতন, তোর মেয়ে কী সুন্দর একটা কবিতা বলল!” বলল দাদু।
লজ্জায় তখন আমি মুখ লুকোনোর চেষ্টা করলেও সবাই আমাকে ধরে ফেলল। আর আমি খিলখিল করে হেসে ফেললাম। তখন আলতো আওয়াজে মধুর সুরে হারমোনিয়াম বাজানো শুরু হল। বাজানো শুরু করল আমার মিষ্টি মা—দ্য হারমোনিয়াম এক্সপার্ট। গানে মেতে উঠল আমাদের মল্লিক পরিবার।
তারপর ঠাম্মি আমাদের বাড়ির ব্যাপারে ও এই বিশেষ দিনটার বিষয়ে আবার বলতে শুরু করল, “জানো দিদিভাই, এই বাড়ি আমার শ্বশুরের বাবার। নাম ছিল শ্রী মন্দ্রীনাথ মল্লিক। উনি কবিগুরুর খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। উনি বলেছিলেন এই বাড়িতে যেন প্রতিবছর ওঁর বন্ধুর জন্মদিনে সুস্বাদু পায়েস রান্না করা হয়। চলো, আজ তুমি পায়েসটা কবিগুরুর ছবির সামনে রেখে প্রণাম করে এসো।”
ঠাম্মির আদেশ শুনে আমি তাই করলাম।
আজ সব নতুন লাগছে। সাহিত্য আর গানে আজ শুধু আমাদের বাড়িই নয়, দুনিয়ার সমস্ত দেশের প্রত্যেকটা বাসিন্দা যেন মেতে উঠেছে। আমি বুঝতে পারলাম, সাহিত্য আর সংগীত তো বাঙালির ঐতিহ্য। তাই আমাদের সেইসব বাঙালিদের মনে রাখা দরকার যারা বাঙালির ঐতিহ্য ও পরম্পরার, সাহিত্য ও সংগীতের নির্মাণ ঘটিয়েছেন।
দুই শতাব্দী। গোটা বিশ্ব চরম অস্থির। একের পর এক ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ঘটনা। তারই মাঝে সে নজরদারি করে চলেছে গোটা বিশ্ব। খিদিরপুর থেকে চিনের ক্যান্টন, সুদূর আফ্রিকার সাভো নদীর তট থেকে ইম্ফল, নিউ পাপুয়া গিনির রহস্যময় ভূগর্ভস্থ জগৎ - কোনও স্থানই তার দৃষ্টিপথের বাইরে নয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পথ চলে তার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সে নির্দেশ অমোঘ, অলৌকিক। তা অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। সে জিচোলা তাতু।
রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়, অলৌকিক, যুদ্ধ আর ইতিহাস দিয়ে গেঁথে তোলা হয়েছে রুদ্ধশ্বাস দুই শতাব্দীর আখ্যান।
দু-হাজার তিনশো বছর আগে পাটলিপুত্র থেকে তক্ষশিলা পর্যন্ত বাণিজ্যদলের সংঘাতবহুল রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ শেষে এক তরুণ পৌঁছল তক্ষশিলায়। সেই নগরীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তাল। একদিকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার, অন্যদিকে আচার্য কৌটিল্যের অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে মশগুল একদল যোদ্ধা। অসংখ্য চরিত্রের ঘনঘটা, ষড়যন্ত্র, কাপুরুষতা আর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে কিছু মানুষের আত্মমর্যাদা আর স্বাধীনতা রক্ষার সাহসী সংগ্রামের আখ্যান এই উপন্যাস।
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য ▪️ অংশু পাণিগ্রাহী ▪️ রম্যাণী গোস্বামী ▪️ অরিন্দম দেবনাথ ▪️ সুব্রত দাস ▪️ বাণীব্রত গোস্বামী ▪️ এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল ▪️ কিশোর ঘোষাল ▪️ মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ি ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সংঘমিত্রা রায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ অমিত চট্টোপাধ্যায় ▪️ অর্ণব ভট্টাচার্য ▪️ বদ্রীনাথ পাল ▪️ স্বপনকুমার বিজলী ▪️ বসন্ত পরামাণিক ▪️ মলয় সরকার ▪️ মানস চক্রবর্তী ▪️ মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ▪️ নীলেশ নন্দী ▪️ পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রানা জামান ▪️ রূপসা ব্যানার্জী ▪️ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ শক্তিপদ পণ্ডিত ▪️ সৌমেন দাস ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ সুমিত্রা পাল ▪️ তাপস বাগ ▪️ আলমগীর কবির ▪️ রমিত চট্টোপাধ্যায়
বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ মেঘনা নাথ ▪️ শাশ্বত কর ▪️ সুমন সেন ▪️ রণিত ভৌমিক
অরিন্দম ঘোষ ▪️ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ▪️ রাখি পুরকায়স্থ
কেয়া চ্যাটার্জী ▪️ দীপক দাস ▪️ ড. উৎপল অধিকারী ▪️ সুদীপ ঘোষাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
বিশ্বদীপ পাল ▪️ অঙ্কিতা নন্দী ▪️ সুজাতা চ্যাটার্জী ▪️ বুমা ব্যানার্জী দাস ▪️ পুণ্ডরীক গুপ্ত ▪️ স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায় ▪️ প্রবাহনীল দাস ▪️ সায়ন্তনী পলমল ঘোষ ▪️ সুমন দাস ▪️ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী