দীপক দাস

জার্নালিস্ট, গল্পকার, ফুড ব্লগার

আগুন... আমাজন... জঙ্গলমহল


ফ্রান্সিসকো পিজারো দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কানে এসেছে এক সোনার দেশের কথা। যেখানে পথে-ঘাটে নুড়ি-পাথরের মতো সোনাদানা পড়ে থাকে। স্পেনের রাজদরবারের সায় আছে এমন অভিযানে। সোনার দেশের খোঁজ মানে তো স্পেনের রাজকোষ ভরে ওঠা। এই দলেই পরে যোগ দিয়েছিলেন ফ্রান্সিসকো ডি ওরেলানা। পিজারো চলে গেলেন অন্য পথে। আর ওরেলানা আবিষ্কার করে ফেললেন আমাজন। সোনার দেশের সন্ধান তিনি পাননি। পাননি আমাজোনাস নামে কিংবদন্তির সেই নারী-যোদ্ধাদেরও। কিন্তু বহিরাগত শক্তিদের জন্য একটা অশুভ পথ খুলে দিয়েছিলেন ওরেলানা। সেই পথ ধরেই শতকে শতকে আমাজনের বুকে হাজির হয়েছে লোভীদের দল। ও হ্যাঁ, পিজারোর লোভের শিকার হয়েছিল আরেকটি জনপদ। পেরু। ইনকা সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারিগর পিজারো। একই অভিযাত্রী দলের দুই শাখা বিপদের বীজ এনেছিল দুই ভূখণ্ডে। পেরুও আমাজন জঙ্গলের অংশ।

২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর। ‘ডেইলি মেল’ একটি খবর করেছিল। ব্রাজিলে সোনা খুঁজিয়ের দল আমাজনের এক জনগোষ্ঠীর ১০ জনকে খুন করেছে। এই জনগোষ্ঠী লোকচক্ষুর আড়ালে থাকত। ওরেলানাদের উত্তরসূরি মনে হচ্ছে না এই সোনা খুঁজিয়েদের? এই খবরটির চুম্বকেই আরেকটি হাড় হিম করা তথ্য রয়েছে। ২০১১ সালে মাদক চোরাচালানকারীদের আক্রমণে একটি জনগোষ্ঠীর সকলে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ‘অদৃশ্য’ শব্দটি সংবাদমাধ্যম আইন বাঁচিয়ে ব্যবহার করেছে। এখানে খুন শব্দটিই সুপ্রযুক্ত।

সম্প্রতি পড়া শেষ করলাম ‘অনলগর্ভা’। বইয়ের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে, ‘ক্লাইমেট ফিকশন’ হিসেবে। লেখক তাঁর কথায় বলছেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্লাইমেট পলিটিক্স ও স্বার্থলাভ’-এর কাহিনি। সেই কাহিনি বলা হয়েছে ‘অ্যাডভেঞ্চার ও থ্রিলার'-এর মোড়কে। অ্যাডভেঞ্চার এবং থ্রিলার কাহিনির সমালোচনায় মুশকিল একটাই, বেশি আলোচনা করলে তা নষ্ট-সূত্র হতে পারে। ইংরেজিতে যাকে বলে স্পয়লার। তার মধ্যেও যেটুকু বলার, এই কাহিনির বিস্তার বিস্মিত করে। স্বার্থলাভের অক্টোপাশের শুঁড় কত দেশে আর কোন কোন ক্ষেত্রে তার চোষক নল ঢুকিয়েছে! কতরকম যে চক্রান্ত চলছে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’টাকে ছিদ্র করার! সে চক্রান্ত রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, বৈজ্ঞানিকও কিছুটা। অবশ্য বাণিজ্যই বাকি দুই ক্ষেত্রকে টেনে এনেছে চক্রান্তের মধ্যে। আশ্চর্য লাগে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার চক্রান্তে শামিল হওয়ার খবরে। এ-কাহিনির চক্র পাক খেয়েছে আমাজনের জঙ্গলে লাগা আগুন ঘিরে।

তবুও ‘এ ফিউ গুড মেন’ পরিবেশ বাঁচাতে জীবন বাজি রেখেছেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়তে রাজি একাগ্র পরিবেশকর্মী, মানুষের কথা ভাবা বিজ্ঞানী, স্বেচ্ছাসেবী ফায়ার ফাইটাররা।

থ্রিলারের স্বাদ বাড়ে তার প্রসাদগুণে। লেখক সুদীপ চ্যাটার্জী তাতে উত্তীর্ণ। তরতর করে পড়া যায়। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন, হলিউডের কোনও অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলারের চিত্রনাট্য। শেখা হয়ে যায় নতুন অনেক কিছু। লেখক পরিশ্রম করেছেন ফিকশনের তথ্য সংগ্রহে। তার প্রমাণ রয়েছে বইয়ের পাতায়। বাস্তব সমস্যার ভিত্তিতে উপন্যাস। তবে ফিকশনের স্বাদও ষোলো আনা মিলবে।

কীভাবে আমাজন বর্ষণবনকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হচ্ছে? একটি উদাহরণ দিলে তেমন ক্ষতি হবে না। জঙ্গলের মাঝে সয়াবিন চাষ করা হচ্ছে রাষ্ট্রের মদতে। যাতে অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। মনে পড়ে গেল বাস্তবের একটা ঘটনার কথা। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের এক জেলায়, জঙ্গলের মধ্যে চা চাষ করা হচ্ছে পঞ্চায়েতের মদতে। সেই ভারসাম্য নষ্টের খেলা।

ওরেলানাদের লোভের বিষবৃক্ষের চারা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাতেই পরিবেশ হয়ে উঠছে ‘অনলগর্ভা’।

দেবারুণ ব্যানার্জী


ক্লাইমেট ফিকশনের নাম আগে কখনও শুনিনি, তাই নাম শুনে পড়ার একটা কৌতূহল ছিল। অপারেশন ব্ল্যাক অ্যারো পড়ার সুবাদে লেখক সুদীপ চ্যাটার্জীর লেখনীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম আগেই। তাই যখন জানতে পারলাম অনলগর্ভা ওঁরই লেখা ক্লাইমেট ফিকশন, তখন পড়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না। অবশেষে কিনেই ফেলা গেল। পড়াও শুরু হল। হ্যাঁ, বলতে হবে বইয়ের মতো বই লিখেছেন বটে লেখক। প্রকৃতি কীভাবে ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত সেই নিয়েই এই বই। ব্রাজিলের আমাজন অরণ্যকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গল্পের ছায়ায় মেশানো কঠিন সত্য ও অ্যাডভেঞ্চার। সঙ্গে অ্যাকশন বা থ্রিলেরও কমতি নেই। বর্তমান যুগে কর্পোরেট লবিবাজি কতটা শক্তিশালী এবং মুনাফাপ্রেমী হলে এবং একটা দেশের নির্বাচিত সরকার কতটা ক্ষমতালোভী হলে অরণ্য ধ্বংস করতে অনুমতি দেয় তার সুস্পষ্ট দিক ফুটে উঠেছে গল্পে। সরকারের এই স্বেচ্ছাচারীতা রুখতে এবং প্রকৃতিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে একদল সমাজসেবী ও মিডিয়া। সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য ইতিমধ্যেই সরকার তাদের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের তালিকাভুক্ত করেছে। যদিও তারা বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সরকারের যাবতীয় অন্যায় পদক্ষেপের বিরূদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যেতে উদ্যত হয়। ইতিমধ্যে আমাজন অরণ্যে কেউ বা কাদের ষড়যন্ত্রে ভয়ংকর আগুন লাগে। সেই আগুন নেভাতে গিয়ে একাধিক কর্মী এক ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হন। শুধুমাত্র কর্পোরেট স্বার্থ কীভাবে প্রকৃতির ক্ষতি প্রতিনিয়ত করে চলেছে তার সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় এই লেখায়, উপরন্তু গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে লাইভ স্টক ফার্মিং। গল্প পড়লে বোঝা যায় এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর যুগে স্কট, লিওনার্দো, এলিজা, জোসেফিন, আরিফ, মার্সেলো এদের মতো ব্যক্তিত্ব খুব দরকার, যাতে কর্পোরেট চক্রান্ত এর হাত থেকে প্রকৃতি বাঁচতে পারে অন্তত মানবসভ্যতার খাতিরে। লেখনী যথেষ্ট সাবলীল ও চমৎকার। তবে কাহিনির ইতিটা লেখক একটু তাড়াতাড়ি টেনেছেন বা অতি সরলীকরণ করে ফেলেছেন বলে মনে হল।

প্রকাশককেও অনেক ধন্যবাদ সাধারণ গড়পড়তা ধারণার বাইরে গিয়ে এরকম ভিন্ন স্বাদের কাহিনি পাঠককুলের সামনে তুলে ধরার জন্য। লেখক আর প্রকাশকের কাছে আশা রইল ভবিষ্যতেও যেন এরকম আনকমন বই পাব।

আর স্কট, এলিজা এরা কারা এবং কোন মাইক্রো-অর্গানিজম কীভাবে ওই ভয়ংকর রোগের জন্য দায়ী, তা জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে বইটা।


রেটিং: ৭.৫/১০