দীপক দাস

জার্নালিস্ট, গল্পকার, ফুড ব্লগার

পুলিশের চোখে

‘মারের শেষ ঝাঁটার বাড়ি, চাকুরির শেষ দারোগাগিরি’। পুলিশের চাকরি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ছিল। যথেষ্ট অবমাননাকর। চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময়ে এরকম ধারণা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেলে কাজকে ভালোবাসা সম্ভব? যখন নিজেই বলছেন, ‘এ-কথা ঠিকই যে আমার এছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না। কিন্তু আমার যে তখন মাত্র উনিশ-কুড়ি বছর বয়স। যে আবেষ্টনীতে ঢাকা ছাত্রজীবন কাটিয়েছি তাতে তো কোনোমতেই আমার এই চাকরি-প্রাপ্তি মানসিক শান্তি আনতে পারেনি। যদিও আর্থিক সমস্যা কিছুটা লাঘব হয়েছিল’। লেখক দিগেন্দ্র চন্দ্র ব্যানার্জ্জী। বইয়ের নাম ‘অসমাপ্ত এজাহার’। প্রকাশক একপর্ণিকা প্রকাশনী।

দিগেন্দ্র ছিলেন এক পুলিশ অফিসার। ঢাকার বাসিন্দা। সারাজীবন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করেছেন। প্রথম জীবনে পূর্ববঙ্গে। স্বাধীনতার পরে ভারতে চলে আসেন। প্রথমে রেল পুলিশে ছিলেন। পরে সি.বি.আই.-এ যোগ দেন। পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পদকও। তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথা লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তাই বইয়ের নামে অসমাপ্ত শব্দটি। চাকরিকে ভালোবেসেছিলেন। দায়িত্ববোধে ছিলেন সজাগ। তার প্রমাণ রয়েছে বইয়ের ছত্রে ছত্রে।

পুলিশের কথা বাঙালি পাঠক বহুদিন থেকে পড়ে আসছে। প্রিয়নাথ দারোগা, অভিনেতা-পুলিশ ধীরাজ ভট্টাচার্য, হাল আমলের লালবাজারের বই বা এক পুলিশের সাদাত্ব-কালোত্ব। দিগেন্দ্র দারোগার বইয়ে তাহলে কী আছে? অনেক কিছু। রহস্য গল্পের স্বাদ আছে। ইতিহাস আছে। আর্থ-সামাজিক জীবনের ছবি আছে। সে-কালের পুলিশি ব্যবস্থার রকমসকম আছে।

‘আমিনাবিবি হত্যা মামলা’, ‘ফুলবিবি হত্যা মামলা’ ‘আড়াইপাড়া ডাকাতি মামলা’ পুরোপুরি স্বাদু রহস্য গল্প। কিন্তু পুলিশের লেখা আর পেশাদার লেখকের লেখায় তফাত থাকে। পুলিশের লেখায় প্রচুর সাব-প্লট থাকে না। রহস্য বজায় রাখতে আগে-পিছে থাকে না। অভিজ্ঞতা থেকে একটা আন্দাজ হয়। আর সেই আন্দাজকে সত্য করতে প্রমাণের পিছনে ছোটা। সে-কালে পুলিশের কাজ যে কতটা কঠিন ছিল তার সুস্পষ্ট ছবি এই লেখাগুলোয়। সাইকেলে, হেঁটে, নৌকায় তদন্ত করতে যাওয়া। বনপথে, ভাঙা রাস্তায়, ভরা নদীতে। একটি ঘটনায় গুলি চলেছিল। ব্যালাস্টিক রিপোর্ট করাতে কলকাতায় আসতে হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। এত অভাব নিয়ে পুলিশি ব্যবস্থা কী করে টিকে ছিল কে জানে!

আর্থ-সামাজিক ছবিও খুব স্পষ্ট। চাষের কথা, নানাধরনের নৌকো, মানুষের মানসিকতা, মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টার নানা ছবি স্পষ্ট। রয়েছে বিচার ব্যবস্থার ছবিও। অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট ভালো পুলিশ-মন্দ পুলিশের কথাও রয়েছে। দেশভাগের যন্ত্রণাও রয়েছে। ব্রিটিশ পুলিশের চাকুরে ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলন কেমন চোখে দেখতেন? স্পষ্ট করেছেন নিজের অবস্থান। রাজনীতি সে-যুগেও পুলিশকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করত। সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। রয়েছে সেই নেতার নামও।

একটা বিষয় খুব খারাপ লেগেছে। বিলে পাখি শিকার। শিকারি স্বয়ং পুলিশের বড়কর্তা। তাঁকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন দিগেন্দ্র। এমন পাখি শিকারের ঘটনা সেলিম আলির ‘চড়াই উতরাই’ বইয়েও পেয়েছি। ব্রিটিশ পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের খুশি করতে রাজরাজড়ারা আয়োজন করতেন। রাজপুরুষেরাও নানা সময়ে শিকারে যেতেন। প্রশাসনিক এবং সামাজিক হর্তাকর্তারা বাস্তুতন্ত্রের বারোটা বাজিয়েছেন বহুযুগ থেকেই। এখন আমরা তার ফল ভোগ করছি।