SMARACHIHNA REVIEWS

কৃষ্ণা ভট্টাচার্য

শৈশব বা কৈশোর এমনই এক আলো-আঁধারি সময় যা বেশিরভাগ মানুষকে জীবনভর এক মায়াবী চাদরে জড়িয়ে রাখে। হাজার দায়িত্ব, ব্যস্ততা বা জীবন-যুদ্ধে টানাপোড়েনের মাঝ থেকেও সে হঠাৎ উঁকি মেরে তার অস্তিত্ব জানান দেয়। কারুর স্মৃতি বিশদ, কারুর-বা খণ্ড চিত্র। কেউ আপনমনে তাকে লালন করে, আবার কেউ সেই অমূল্য সম্পদ জীবনের কোনও এক পর্যায়ে এসে সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেবার তাগিদ অনুভব করে। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী মহাশয়ের ‘স্মরচিহ্ন’ তেমনই একখানি স্মৃতিকথা, যা চুম্বকের মতো অমোঘ আকর্ষণে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় অতীতে রেখে আসা সেই হারানো দিনগুলোয়। সেখানে লেখক এবং পাঠক মিলেমিশে একাকার। শৈশব-কৈশোরের কুড়োনো মুক্তোগুলিকে পৃথক পৃথক শিরোনামে রেখেও লেখক এক সূত্রে গ্রন্থিবদ্ধ করেছেন তাঁর স্মরণ-মালায়। সেখানে সারল্য আছে, নির্মল কৌতুক আছে, বয়ঃসন্ধির কৌতূহল আছে, সঙ্গী হারানোর বেদনা আছে, কিন্তু কোথাও এতটুকু বাড়াবাড়ি নেই। এই পরিমিতি বোধই জাত লেখকের বিশেষত্ব। ‘ছা’ – কী মধুর সম্বোধনটি! আমি মুগ্ধ। ছায়ের হেঁসেলের অপূর্ব বর্ণনা এক সুখী যৌথ পরিবারের ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। লেখকের ‘উরা’ চরিত্রটি করুণার এক প্রতিমূর্তি। কী ভালোবাসায়, কী মমতায় এক দৃষ্টিহীন অসহায় বৃদ্ধার দায়িত্ব পালন করে গেল সে শেষ দিনটি পর্যন্ত।

‘একের মধ্যে তিন’ এক সাধারণ ছেলের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প। লেখকের ভাষায়, ‘সুযোগের সদ্ব্যবহার করার যে সহজাত প্রবণতা অমৃতর পরবর্তী জীবনে দেখা যাবে, সেদিন খেলার মাঠে ছিল তারই আভাস।’

‘পাঠশালার পনশয়রা’, ‘বাগাল-গুরুর পাঠশালা’ সহ অন্যান্য কথামালাগুলিও সমান সুখপাঠ্য।

জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের অজ পাড়াগাঁয়ে কৈশোর অতিবাহিত আমার, তাই গাছপালা, খালবিল, পুকুর এবং ঋতু অনুযায়ী ফলমূল, আখ, খেজুর-রস, পাটালি, চিটগুড়ের সঙ্গে ছিল গভীর অন্তরঙ্গতা। বর্ষার কর্দমাক্ত রাস্তাঘাট, আবরণহীন পায়ের ক্ষত (আমরা বলতাম, প্যাঁকে খাওয়া, অর্থাৎ পাঁকে খাওয়া) এগুলির সঙ্গে অনুভব করে স্মৃতি কাতর হই।

কাহিনির চরিত্রদের মুখে আঞ্চলিক ভাষাটি বড়ো শ্রুতিমধুর। তাঁদের আবেগ, ক্রোধ, কৌতুক, ভালোবাসার মাধুর্য যেন ভাষার গুণে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

পরিশেষে, প্রথমেই রাজীবকুমার সাহাকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা, বইটি যথাসময়ে আমাকে পাঠানোর জন্যে। লেখক অর্দ্ধেন্দুশেখরকে সাধুবাদ জানাই এমন মনোজ্ঞ এক স্মৃতিভাণ্ডার আমাদের উপহার দেবার জন্যে। বাহবা তাঁকেও যিনি শিরোনামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ছবিগুলো এঁকেছেন।

মৌসুমী ঘোষ

ফাউন্ডার 'স্প্যানিশ ইন আ হারি'

ইদানীংকালে কোনোরকম বাকবিতণ্ডায় না জড়িয়ে যে বিষয় নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব আমার পক্ষে তা হল, শৈশবের স্মৃতি। উঁহু, আমার শৈশব নয়, মায়ের ছোটবেলার কথা। সে-সব গল্পে কখনও আসে মাঠঘাট ঠেঙিয়ে, এমনকি জলাজঙ্গল পেরিয়ে ইস্কুলে যাওয়ার কথা, যাতায়াতের পথে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে দৌরাত্ম্য। বেশিরভাগ গল্পেই একজন বিশেষ সাগরেদ থাকত মায়ের সঙ্গে, তাঁর প্রিয় বান্ধবীটি। আবার কোনোদিন শুনতাম দিদার মুড়ি ভাজার কথা (এ-জিনিস যদিও আমার নিজের চোখেই দেখা), চাষবাসের মরশুমে বিশেষ করে ফসল তোলার সময় আমার দাদু মানে মায়ের বাবা কীভাবে নিজের হাতেই ক্ষেতের সমস্ত কাজকর্ম সামাল দিতেন (কারণ, তিনি নাকি সব কাজেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন), সঙ্গে ছেলেমেয়েদেরও ট্রেনিং পর্বের খুঁটিনাটি। কীভাবে পাট বাঁধতে হয়, দিনের কোন সময় সে-সব কাজ করতে হয় এবং কেন, অন্য ভাইবোনদের না থাকলেও মায়ের এসব বিষয়ে জানার দারুণ আগ্রহ ছিল, তাই চাষের অনেকরকম টেকনিক্যাল দিক নিয়ে মা অবলীলায় চর্চা করতে পারে। একদিকে তাঁদের একান্ন পরিবারের অভিভাবকদের কড়া অনুশাসন, অন্যদিকে পুকুরঘাটে ডানপিটেপনা সব ধরনের গল্পই শুনেছি। আর এসবই শুনেছি বহু-বহুবার। ফলত সব ঘটনাই আমার মুখস্থ। তবু এসব পুরোনো কথন নতুন করে শুনতে কোনোদিনই খারাপ লাগে না। নিখাদ আনন্দের প্রত্যাশা, গল্পকথক ও শ্রোতা দুজনের মনেই।

ভাবছেন এত গৌরচন্দ্রিকা কী উদ্দেশ্যে? বই পড়ে কেমন লাগল সে-কথা বললেই মিটে যায়। ভূমিকাটুকু আসলে মায়ের সঙ্গে গল্প আসর আর এই বইয়ের পাঠ, এই দুইয়ের মধ্যে অনুভূতির মিলটুকু তুলে ধরার জন্য। উপরি পাওনা এই যে লেখক আমাদের তাঁর অতীতের দোরগোড়ায় টেনে নিয়ে গিয়ে শুধুমাত্র দাঁড় করিয়ে রাখেননি, কাহিনির অভূতপূর্ব বর্ণনায় পাঠক যেন তার অংশ হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে গ্রাম-মফস্‌সলের আঙিনায় বয়েছে যাঁদের কিছুটা জীবন, তাঁরা ভীষণভাবে একাত্ম হতে পারবেন এই লেখার সঙ্গে। আর যদি জন্মাবধি পাঠক শহুরে মানুষ হন, তবে বলব তাঁর হাতে এক অনন্য জগতের চাবিকাঠি তুলে দিয়েছেন লেখক তাঁর এই অপূর্ব লেখনীর মাধ্যমে।

এই বইয়ে আমি কী কী পেয়েছি?

সততা, লেখনীর সারল্য, যথোপযুক্ত ভাষার ব্যবহার, হাস্যোদ্রেককারী বেশ কিছু মুহূর্ত, স্মৃতিকাতরতাহীনতা। বেশ কিছু অধ্যায়ে কয়েকটি বিষয়, যেমন খেজুর-রস পাড়া, আখের রস বের করা ইত্যাদি সম্বন্ধে আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। এই ডকুমেন্টেশন আমার বিশেষভাবে ভালো লেগেছে। অনেক সম্পাদক এ ব্যাপারে কাটছাঁট করে দেওয়ার কথা ভাবতেন হয়তো, কিন্তু এক্ষেত্রে সম্পাদক মহাশয় সেটিকে যে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন এবং তার সদ্ব্যবহার করেছেন, সেজন্য রাজীবদাকে আলাদা করে ধন্যবাদ দিতেই হয়।

বইটি যেহেতু লেখক তাঁর স্মৃতির মাটি খুঁড়ে লিখেছেন তাই কিছু জৈবনিক আক্ষেপ ও হতাশা বাদ দিলে পুরো বইটি জুড়েই শৈশবের অম্লমধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে, যার বেশিরভাগের মধ্যেই রয়েছে অসামান্য 'কমিক এলিমেন্ট'। তাই বিলকুল প্রাণ খুলে হাসতে চাইলেও এই বই নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নিতে পারেন। আর যে-বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করলে সত্যিই অন্যায় হবে, তা হল গল্পের সঙ্গে যথোপযুক্ত ছবি ও অলংকরণ ও বইয়ের প্রচ্ছদ। বিশ্বাস করি, প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শুরুতে দেওয়া ছবিগুলি অনেকেরই অনেকরকম বাল্যস্মৃতি উস্কে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।